শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

"পহেলা বৈশাখ ও সাম্প্রদায়িক বিতর্ক "

রোববার, এপ্রিল ১৪, ২০২৪
"পহেলা বৈশাখ ও সাম্প্রদায়িক বিতর্ক "

ইমদাদুল হক সোহাগ:

সামনে আমাদের সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব বৈশাখ। বৈশাখ হলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রাণের উৎসব, বাঙালির উৎসব। আমাদের শেকড়ের উৎসব। আর ঈদ, পূজা হলো নিদিষ্ট ধর্মের উৎসব। তাই পহেলা বৈশাখ হলো সত্যিকারের  জাতীয় উৎসব।এটাই ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সংস্কৃতি।অথচ স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি পহেলা বৈশাখে এ বর্ষবরণ উদযাপন কে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি ও ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক ও হারাম মনে করে।

আসলেই কি তাই? আসুন জেনে নেই সংস্কৃতি কি? অনেকে মনে করেন সংস্কৃতি হলো  নাচ, গান, অভিনয়, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি। আসলে এগুলোই সংস্কৃতি না,এগুলো হলো  সংস্কৃতির অংশ বিশেষ মাত্র ।

সংস্কৃতি হলো একটা নির্দিষ্ট ভূ খন্ডে বসবাসকারী জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সামগ্রিক জীবন প্রনালী বা জীবনাচার। এর মানে হলো, আমরা বেঁচে থাকার জন্য এবং চিত্ত বিনোদনের জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত  যা যা  করি সব কিছুর সমষ্টি হলো সংস্কৃতি।জেলের মাছ ধরা, কামার-কুমারের লৌহজাত দ্রব্য ও মাটির জিনিস তৈরি, মাঝির নৌকা বাওয়া, কৃষকের হালচাষসহ সকল পেশা যেমন সংস্কৃতি তেমনি জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম,রুণা-লায়লা বা আব্বাস উদ্দীনের গান, রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎ চন্দ্রের সাহিত্য কর্ম, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র সবই সংস্কৃতি। আবার আমাদের সামাজিক রীতি-নীতি, পালা-পার্বণ, উৎসব, লোকাচার, খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা সবই সংস্কৃতির অংশ।

অনেক প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদি বলে থাকেন পহেলা বৈশাখ  মুসলমানদের সংস্কৃতি না।আসলে মুসলমান জাতি নয়, একটি সম্প্রদায়ের নাম।আর বাঙালি হচ্ছে একটি জাতির নাম। জাতি আর সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।যে কোনো মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করে অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে। যেমন, একজন বাঙালি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তিনি খ্রিস্টান হবেন, কিন্তু তিনি ইংরেজ জাতির অংশ হবেন না। বাঙালি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আরব জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

বাঙালি একটি জাতি এবং এই জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। বাঙালি বলতে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে বুঝায়। বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, উৎসব পার্বণ নিয়ে গাত্রদাহী লোকজনের পূর্বপুরুষরাও আদিম ধর্ম থেকেই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন, আরবীয় থেকে নয়। আরবরা মুসলিম কিন্তু তাদেরও নির্দিষ্ট ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতি ও উৎসব পার্বন রয়েছে যা বাঙালিদের থেকে সম্পুর্ণ আলাদা। ধর্ম ও ভাষা, কৃষ্টি -সংস্কৃতি, জাতীয়তা সম্পূর্ণই আলাদা বিষয়। কেবল ধর্মীয় যোগসূত্র বা মুসলিম হবার কারনেই নিজ জাতির সম্পর্ক, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে  উপেক্ষা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সুদূর আরব্য মরু সংস্কৃতিকে ইসলামিক বা এ অঞ্চলের মুসলিমদের নিজেদের মনে করা মূর্খামি ছাড়া কিছুই নয়। বিশ্বব্যাপী মানুষের একে অপরের সাথে ধর্মীয় সম্পর্কের চেয়ে নিজ জাতি ও কৃষ্টি সংস্কৃতির সম্পর্কটাই মূখ্য।খেয়াল করে দেখবেন,প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের  মতের বিপরীতে কিছু হলেই তা হিন্দুয়ানী, তাই হারাম, তাই হবে শিরক, আবার হাদিসও অনেক সময় জাল-জয়িফ বলে ফতোয়া জারি করে দেন।

এই জাল-জয়িফ, হালাল-হারামের যত্রতত্র ওয়াজ-নসিহত, প্রোপাগান্ডা, মিথ্যা বানোয়াট তথ্য ইসলামকে কলুষিত করেছে।হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবের অধিকাংশ মানুষই ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী ছিলো,বলতে গেলে তখন এই ভিন্ন ধর্মের মানুষের ভাষা ছিলো আরবি,আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মদ ( সা:) তো আরবি ভিন্নধর্মী মানুষের ভাষা ছিলো বলে সেটাকে বয়কট করেন নাই।ঠিক তেমনিভাবে বয়কট করেন নাই আরবের  ভিন্নধর্মী মানুষের পোষাক-পরিচ্ছেদ।আল্লাহর সাথে শিরক করা ছাড়া অধিকাংশ আরবীয় সংস্কৃতিকে তিনি ধারন করেছেন হ্নদয়ে লালন করেছেন।

ইসলাম আরব দেশ থেকে ভারতবর্ষ ও আমাদের বাংলায় এসে প্রচার প্রসারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে তা এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিস্তার লাভ করেছে। বাঙালি মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা হিন্দু বা কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে। কিন্তু ইসলামে ধর্মান্তরিত হলেও তাদের ভাষা ও কৃষ্টি সংস্কৃতি পূর্বেরটাই রয়ে গেছে। এ যুগের কট্টরপন্থী ও রক্ষনশীল মৌলবাদীরা নিজ জাতির কৃষ্টি সংস্কৃতির চেয়ে আরব্য মরু সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে এমনকি তা নিজ সংস্কৃতি বলেও জাহির করছে। যারা এর বাইরে যাচ্ছে বা পূর্বের নিজ কৃষ্টি সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে তারা ওসব প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদিদের রোষানালে পড়ছে।প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদিরা যতোই মনগড়া ফতোয়া দিক না কেনো, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি আরব্য সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ বিষয়ে ভিন্নমত পোশনকারীরাধর্মান্ধ,পতিক্রিয়াশীল,
সাম্প্রদায়িক ও মূর্খ  ছাড়া কিছুই নয়।


আসুন ধর্মের সুমহান বাণী প্রচার করি। যে বাণী ভালবাসার কথা বলে, ঘৃণার কথা নয়, যে বাণী গ্রহণের কথা বলে বর্জনের কথা নয়, যে বাণী শান্তির কথা বলে,  সংঘাতের কথা নয়।পহেলা বৈশাখ  এই দেশের ভূমিজাত সংস্কৃতির অঙ্গ। এর সাথে অন্য ধর্ম বিশ্বাসের কোনরকম সংঘাত নেই। শুধু শুধু একে কলুষিত করবেন না। বাঙালি মুসলিমদের বাঙালিত্ব আর মুসলমানিত্ব দুইই অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা। কারণ আপনি আমি চাইলেও আমার চেহারা, ভাষা ইত্যাদি পরিবর্তন সম্ভব নয়।ধর্মের সাথে সংস্কৃতির যে কোন সাংঘর্ষিক  সম্পর্ক নাই তার বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে পৃথিবীতে মুসলিম প্রধান দেশ আছে চল্লিশটির মতো৷ সবার ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এক ও অভিন্ন। সব দেশের মুসলমানরাই নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ্ব করে, ঈদ পালন করে। কিন্তু তাদের সংস্কৃতি এক নয়৷ চল্লিশ দেশের সংস্কৃতি আলাদা। প্রতিটি দেশের খাবার-দাবার,  পোশাক-পরিচ্ছদ, পেশা, সামাজিক রীতিনীতি,  উৎসব, পার্বণ, সংগীত, নৃত্য সবকিছু আলাদা। কারণ তারা ভিন্ন ভূখন্ডে বসবাসকারী  ভিন্ন জাতি। তেমনি আমরা মুসলমান হওয়া সত্বেও জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি এবং আমরা বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করি, পালন করি৷ এই বিষয়টাই প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরা বুঝতে পারেনা, বুঝতে চায়না৷প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরা বাঙালি সংস্কৃতিকে মনে করে হিন্দু সংস্কৃতি।অথচ বাঙ্গালী  সংস্কৃতি আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে।

সংস্কৃতি ছাড়া কোন জাতি বা মানুষ বাঁচতে পারবেনা। কারণ আগেই বলেছি, আমরা সকাল থেকে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত যা যা করি সবই সংস্কৃতি। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ধর্মেরও বহু আগে থেকে আমাদের সংস্কৃতির উৎপত্তি।নবী করিম (সা:) প্রদর্শিত ইসলাম ধর্ম আসছে ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দের পরে আর আমাদের  উপমহাদেশে আসছে ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খজলির বাংলা বিজয়ের পরে। কিন্তু যেদিন থেকে মানুষের উৎপত্তি সেদিন থেকে সংস্কৃতির উৎপত্তি। ধর্ম ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে, কিন্তু সংস্কৃতি ছাড়া এক মুহুর্ত চলবেনা। অথচ এমন অপরিহার্য বিষয়টিকে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদিরা অস্বীকার করে, ধর্ম বিরোধী বলে ফতোয়া দেয়।

পরিশেষে একটি কথাই বলবো ধর্ম হোক ধর্মাবলম্বীদের; উৎসব হোক সবার। এ পৃথিবী হোক মানুষ ও মানবতার। অশুভ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিনাশ ঘটুক। মঙ্গল আলোকে সম্প্রীতির বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়ে উঠুক। এটাই হোক সবার কাম্য।


ইমদাদুল হক সোহাগ
শিক্ষক,বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
ববঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-গোপালগঞ্জ।


সময় জার্নাল/এলআর


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল